মধ্যপ্রাচ্যে যত উচ্চশিক্ষিত এবং স্বনির্ভর জাতি রয়েছে তাদের তালিকা করলে সবার উপরে থাকবে ইরানের নাম। দীর্ঘ সময় ধরে ইরানের উপরে কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও দেশটি ভালোভাবে সকল বাঁধা উতরে যেতে পেরেছে। কুর্দি, আজহারী, বেলুজ, মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি সহ নানা ধর্ম এবং জাতি গোষ্ঠীর লোকের বসবাস এখানে। ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি অথবা রাজনীতি সবদিক থেকে ইরান বেশ সমৃদ্ধ। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকার পর একা হয়ে গেলেও যেভাবে তারা টিকে আছে তা বিশ্বের বুকে একটি অনন্য উদাহরণ।
ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান
ভৌগোলিকভাবে ইরান পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশ। মানচিত্রে ইরানের উত্তর পশ্চিম দিকে রয়েছে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান। দেশটির উত্তর দিকে শুরু হয়েছে কাস্পিায়ান সাগরের সীমানা। উত্তর-পূর্ব দিক দিকে কাস্পিয়ান সাগরের সীমানা শেষ হয়ে গেছে। সেখান থেকে শুরু হয়েছে তুর্কেমিনিস্থানের বর্ডার। তুর্কেমিনিস্থানের সাথে ইরানের বর্ডার রয়েছে এক হাজার কিলোমিটার। ইরানের উত্তর পূর্ব দিকের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তুর্কেমিনিস্থানের সীমানা।
দেশটির পশ্চিমে অবস্থান করছে আফগানিস্তান। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সাথে ইরানের ৯২১ কিলোমিটারের বর্ডার রয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটির ৯৫০ কিলোমিটারের সীমানা রয়েছে। ইরানের দক্ষিণে ওমান উপসাগর অবস্থিত। ওমান সাগরের পশ্চিমে পারস্য উপসাগরের সাথে ইরানের সীমানা রয়েছে।
ভৌগলিকভাবে ইরান বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কেননা গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ ইরানের কাছেই রয়েছে। বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে হরমুজ প্রণালীর ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। ইরানের পশ্চিম দিকে অবস্থিত মিশর। মিশরের সাথে ইরানের ১৫৯৯ কিলোমিটার এর সীমানা রয়েছে। স্থল সীমান্তের কথা চিন্তা করলে ইরাক হচ্ছে দেশটির সবথেকে বড় প্রতিবেশী।
ইরানের পশ্চিম দিকের বাকি অংশটা জুড়ে রয়েছে তুরস্ক। দেশটির সঙ্গে ইরানের ৫৩৪ কিলোমিটারের সীমানা রয়েছে। দেশটির আয়তন হচ্ছে ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৫ কিলোমিটার এবং এটি পৃথিবীর ১৭ তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। বিশাল আয়তনের দেশে ৩০টি আইল্যান্ড রয়েছে। মূলত পারস্য উপসাগরকে কেন্দ্র করে এসব আইল্যান্ডে গড়ে উঠেছে। মরুর বুকে অবস্থিত দেশটিতে তিনটি নদী রয়েছে।
বিশ্বের অনেক উঁচু পর্বত শৃঙ্গ দেশটির মধ্যে অবস্থিত। ইরানে প্রায় ১৫০০ এর উপরে পর্বত শৃঙ্গ রয়েছে। এর মধ্যে মাউন্ট ড্রামাভান্ড পর্বত শৃঙ্গ হচ্ছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের সবথেকে উঁচু পর্বত শৃঙ্গ। এটি ৫৬১০ মিটার উঁচু পর্বত শৃঙ্গ। এটি উচ্চতায় এতই বড় যে ছয়টি বুর্জ খলিফার সমান হবে প্রায়। ইরানের বিশাল ভূমি সুউচ্চ পাহাড়ে বেষ্টিত। ইরানের বৈচিত্র্যময় পাহাড় এবং পর্বত দেশটিকে প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষা দেয়। উদাহরণ হিসেবে ইরাক-ইরান যুদ্ধের কথা বলা যায়। ওই সময় ইরাকের সেনারা দেশটির জাগ্রস মাউন্টেন এরিয়াতে এসে আটকে যায়। পর্বত ঘেরা অঞ্চলেই দেশটির বড় বড় শহর অবস্থিত। মাশা, তেহরান, তাবরিচ, ইস্পাহান এবং সিরাজের মত শহরের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ইরানের জাতিগোষ্ঠী ও ইতিহাস
জাতিগতভাবে ইরান আরব নয়। তারা মূলত পার্শিয়ান। পার্শিয়ানদের ইতিহাস আরবদের থেকেও বিখ্যাত এবং বৈচিত্র্যময়। শিক্ষা, চিকিৎসা, গান চর্চা সব দিক থেকে পুরো মধ্যপ্রাচ্চে তারাই ছিল সর্বসর্বা। ইরানের আশেপাশে এবং সীমানা ঘিরে প্রায় ২৪ টি পশ্চিমা সেনাঘাটি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক সেনাঘাটি জল এবং স্থল সীমানা ঘেষে অবস্থিত। ইরান বেশ সাহসী জাতি হিসেবেই এসব বিষয়ের মোকাবেলা করে আসছে।
ইরানের উত্তর পশ্চিমে তুর্কি, আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার জাতিগোষ্ঠীর কিছু লোক বসবাস করে। ভৌগোলিকভাবে ইরানের পশ্চিম দিকে কুর্দিরা বাস করে থাকে। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, আজারবাইজান দেশে নিজের জাতি গোষ্ঠীর লোক যতজন বাস করে তার থেকে ইরানে একই জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বেশি বসবাস করে থাকে। ফারসি তাদের মূল ভাষা হলেও আরো বিভিন্ন ভাষার মানুষ এখানে বসবাস করে।
ইরানের সব থেকে বেশি শিয়া মুসলিম বসবাস করে থাকে। ইরানের মোট জনসংখ্যার ৯৯.৩% হচ্ছে মুসলিম। মুসলিমদের প্রায় 90% শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী। মুসলিমদের বাকি অংশটা জুড়ে রয়েছে সুন্নি মুসলিম। সুন্নি মুসলিমের সবথেকে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আরব এবং বেলুচরা। তবে বর্তমানে দেশটিতে খ্রিস্টান জনসংখ্যার হার দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটিতে ৮৫০০ এর অধিক ইহুদিদের বসবাস রয়েছে।
ইরানের সরকার ও রাজনীতি
ইরান হল একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র যার নেতৃত্বে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং একজন রাষ্ট্রপতি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রাথমিক কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করেন, যখন রাষ্ট্রপতি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। ইরানের সরকার একটি মিশ্র রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে সংগঠিত, যার মধ্যে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র এবং একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসন রয়েছে। সরকার উত্পাদন, বিতরণ এবং সম্পদ আহরণ সহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে।
ইরানের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো তার ইসলামী প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত। এই ব্যবস্থা গণতন্ত্র ও ইসলামী নীতির সমন্বয়ে গঠিত। সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হল উভয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রদান করা, যেখানে জনগণের স্বার্থ সর্বদা বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা একটি নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঘিরে গঠিত, যেখানে নাগরিকরা তাদের নেতাদের ভোট দিতে পারে।
ইরানের পার্লামেন্ট 290 জন সদস্য নিয়ে গঠিত যারা প্রতি চার বছরে একবার নির্বাচিত হয়। সংসদের রয়েছে আইন প্রণয়ন ও সরকারের কার্যক্রম তদারকি করার ক্ষমতা। সর্বোচ্চ নেতা হলেন রাষ্ট্রের প্রধান, যিনি ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী সরকার পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য দায়ী।
ইরানের বিচার ব্যবস্থাকে দেওয়ানি আদালত, ফৌজদারি আদালত এবং বিপ্লবী আদালত সহ বেশ কয়েকটি আদালতে বিভক্ত করা হয়েছে। দেওয়ানি আদালতগুলি দেওয়ানী মামলার শুনানির জন্য দায়ী, যখন ফৌজদারি আদালত ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে। বিপ্লবী আদালতগুলি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিবেচিত মামলাগুলি পরিচালনা করার জন্য দায়ী।
ইরানের সংস্কৃতি
নওরজ উৎসব ইরানের সংস্কৃতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যময়। আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষ যেমন গুরুত্ব পায় তেমনি সেখানে নওরজ উৎসব ততটাই গুরুত্ব পায়। তিন হাজার বছর ধরে পার্শিয়ানরা এ উৎসব পালন করে থাকে। ইরানিরা ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস এখনো ধরে রেখেছে। তাছাড়া আরো ডজন খানেক জাতি গোষ্ঠী সম্পর্কিত বিভিন্ন উৎসব এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে ইরানে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে অন্য দেশে বিয়ের রীতি এবং ইরানের বিয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, বর এবং কনের বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পর অনুষ্ঠানের জন্য যত খরচ হবে তার সব টাকা ছেলের পিতাকেই বহন করতে হয়। দেশিটিতে সাধারন একটি বিয়েতে ২০০০ ডলারের বেশি খরচ হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে দেনমোহরের টাকা শতভাগ প্রদান করতে হয়। এভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। কোন ধরনের যৌতুকের কথা ইরানে কল্পনাও করা যায় না। রাষ্ট্রীয় আইন থাকার কারণে ইরানের ছেলে বা মেয়ে অন্য দেশের নাগরিককে বিয়ে করতে পারে না।
ইরানেরঅর্থনীতি
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের পরে সবথেকে বেশি তেলের রিজার্ভ রয়েছে ইরানের কাছে। সৌদি আরবের পর তারাই সব থেকে বেশি তেল উৎপাদন করে থাকে। ইরানের সবথেকে বেশি তেলের মজুদ রয়েছে পারস্য উপসাগর অঞ্চলে। ইরাক সীমান্তের দিকে খুরজিস্থান অঞ্চলে তাদের সব থেকে বড় তেলের ঘাঁটি অবস্থান করছে। অবশ্য ইরানের 7% তেলের মজুদ পারস্য উপসাগর অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে।
পুরো ইরান জুড়ে ১২৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের মজুদ রয়েছে। এটি বিশ্বের মোট উৎপাদনযোগ্য তেলের ১১ শতাংশ। ইরান প্রতিদিন চার মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করতে পারে। দেশটি চাইলে তেলের উৎপাদন যেকোন মুহূর্তে বৃদ্ধি করতে পারে। তেলের বাইরে দেশটিতে ভালো মানের গ্যাসের মজুদ রয়েছে। ইরানের মোট রপ্তানির ৮০% তেল এবং গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। পুরো বিশ্বে যত জাফরান প্রয়োজন হয় তার অর্ধেকের বেশি উৎপাদিত হয় ইরান ভূখন্ডে। তারা জাফরানকে মূলত স্যাফ্রন নামই দেখে থাকে।
ইরানের সামরিক শক্তি
এত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং প্রতিকূলতা সত্বেও সামরিক শক্তিতে ইরান অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপ এবং হুমকি সত্বেও নব্বই শতাংশ নিজস্ব প্রযুক্তির সহায়তায় সামরিক শক্তিতে সফলতা দেখিয়েছে ইরান। সাবমেরিন, মানুষবিহীন ড্রোন এবং মিসাইল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইরান নিজেদের প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার দেখিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক শক্তির দিক থেকে আধিপত্য বিস্তার করছে ইরান।
ইরানে দুই ধরনের সেনাবাহিনী রয়েছে। একটি প্রথাগত সেনাবাহিনী ও বৈপ্লবিক সুরক্ষা বাহিনী। ইরানের সেনাবাহিনীকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভূ-সেনা , নৌ-সেনা , বায়ু-সেনা ও আকাশ প্রতিরক্ষা সেনা। তবে তাদের বায়ু সেনার বিমানগুলো অধিকাংশ পুরোনো প্রযুক্তির।
ইরানের সামরিক বাহিনী মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম এবং শক্তিশালী। ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। বাসিজ মিলিশিয়া হল একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যা IRGC এর সাথে একযোগে কাজ করে। ইরান একটি অভ্যন্তরীণ অস্ত্র শিল্পও গড়ে তুলেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র, ফাইটার জেট এবং নৌযান সহ নিজস্ব অনেক অস্ত্র তৈরি করার ক্ষমতা রাখে।
পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞা ইরানের অস্ত্র এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষমতাকে সীমিত করেছে।
ইরানের ভ্রমণ
ভ্রমনপিপাসুদের জন্য ইরান সৃষ্টিকর্তা মণ্ডিত অসম্ভব সুন্দর একটি দেশ। যদিও নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে ইরানে সবাই ভ্রমন করতে পারে না। ইরানের বড় বড় সব শহর আপনার কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে। ইরানে এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে ভ্রমণা করলে সবকিছু অসম্পূর্ণ মনে হবে। ইরানের সবথেকে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে পারসিপোলিস। পারস্য সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী ছিল এটি। পারস্য সাম্রাজ্যের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন এখানে আপনি খুঁজে পাবেন।
এছাড়াও রয়েছে ভ্যালি অফ দ্য স্টারস, সগা জানবিল ইত্যাদি। এরমধ্যে সগা জানবিল ইরান ভূখণ্ডের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বাবাক ক্যাসেল হচ্ছে ২৬০০ মিটার উঁচু একটি পর্বত শৃঙ্গ। অন্যান্য পর্বত শৃঙ্গ থেকে এটি বেশ আলাদা। ইরানে গেলে নাসির-উল-মূলক মসজিদ থেকে ঘুরে আসতে ভুলবেন না। উত্তর ইরানের চাউলুস রোড হচ্ছে এমন এক জায়গা যার পাশে জলধারা বয়ে যায় এবং রাস্তাটি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত।
নাসি জাহান স্কোয়ার ইরানের সুন্দর নিদর্শনের একটি। ইরানের ইস্পাহান প্রদেশের সবথেকে উল্লেখযোগ্য জায়গা হচ্ছে এটি। বহু পূর্বে এ অঞ্চলের মানুষেরা হাইড্রোলিক সিস্টেম চালু করেছিল। এ সিস্টেমের নাম হচ্ছে সুস্তার হিস্টোরিক্যাল হাইড্রোলিক সিস্টেম। ব্রিজ অফ ইস্পাহান হচ্ছে এ অঞ্চলের অন্যতম প্রসিদ্ধ একটি জায়গা। জায়গাটি রাতের বেলা সবথেকে বেশি সুন্দর লাগে। দেশটির লুথ মরুভূমি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া দেশটিতে ইসলামিক ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন আপনি খুঁজে পাবেন।
ইরানের খাদ্য
সাধারণত ইরানের প্রধান খাবারের মধ্যে আছে চাল, মাংস (যেমন ভেড়ার, মুরগিবা মাছ), সবজির (যেমন পেঁয়াজ এবং বিভিন্ন শাক) সাথে বাদামের মিশ্রণ এবং বাদাম। তাল, ডালিম, কুইন, প্রুনিস, খুরফু, এবং রেসিনসের মতো ফলের সাথে প্রায়শই সবুজ গুল্ম ব্যবহার করা হয়। ইরানীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মশলার মধ্যে আছে জাফরান, শুকনো লেবু, দারুচিনি এবং পেসলে যা বিশেষ খাবারের সাথে ব্যবহৃত হয়।
৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ইরানিরা একটি বিশেষ মজার খাবার তৈরি করেছিল যা গোলাপের পানি ও সেমাই দিয়ে তৈরি করা হতো। এটি গ্রীষ্মকালে রাজপ্রাসাদে পরিবেশন করা হতো। বরফকে জাফরান এবং ফল ও অন্যান্য স্বাদের সঙ্গে মিশ্রিত করা হতো। আজকের দিনে সর্বাধিক জনপ্রিয় ইরানী মিষ্টি জাতীয় খাবার হচ্ছে আধা জমায়িত নুডলস দিয়ে তৈরী ফালুদা যার শিকড় সাবেক রাজধানী শিরাজ শহরে। বাস্তানি ই জামেরানী ফার্সি শব্দের অর্থ জাফরান আইসক্রিম একটি ঐতিহ্যবাহী ইরানী আইসক্রিম যা সাধারণত “ঐতিহ্যবাহী আইসক্রিম” নামে পরিচিত। অন্যান্য প্রকারের ইরানী ডেজার্টগুলি বিভিন্ন ধরনের চাল, গম ও দুগ্ধবৈচিত্র্যে তৈরি হয়।
ইরানের শিক্ষা
গত কয়েক দশকে ইরান তার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। সকল নাগরিককে উচ্চ মানের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার শিক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ইরানে 6 থেকে 11 বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক, এবং দেশের সাক্ষরতার হার উচ্চ, যেখানে জনসংখ্যার 90% এরও বেশি সাক্ষর। দেশটি মেয়েদের এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
ইরানের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান শক্তি হল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শিক্ষার উপর জোর দেওয়া। দেশটির স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এসব বিষয়গুলির উপর বেশি জোড় দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থী এসব ক্ষেত্রে ভালো ক্যারিয়ার গঠন করছে। তবে ইরানের শিক্ষা ব্যবস্থার সামনে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হল গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার মানের দুরবস্থা। গ্রামাঞ্চলের স্কুলে সম্পদ এবং যোগ্য শিক্ষকের বড় অভাব রয়েছে যার ফলে শিক্ষার মান ব্যহত হয়।
শিক্ষায় আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রবেশাধিকার উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। এখনও স্কুলে যাওয়া ছেলে এবং মেয়েদের সংখ্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রয়েছে। মেয়েরা শিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার সম্মুখীন হতে পারে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইরান সরকার শিক্ষার গুণমান উন্নত করা এবং জেন্ডার গ্যাপ হ্রাস করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য ইরান সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণেও বিনিয়োগ করছে। শিক্ষার্থীদের কর্মশক্তিতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা যেনো থাকে সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।
ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি
ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বরাবরই আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার গোষ্ঠী উদ্বেগের প্রকাশ করে। ইরান সরকার রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক, নারী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের জন্য সমালোচিত হয়েছে।
ইরানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার উদ্বেগের মধ্যে একটি হল রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি আচরণ। অনেক ব্যক্তি যারা সরকারের সমালোচনা করে বা ভিন্নমত প্রকাশ করে তাদের গ্রেফতার করা হয়, আটক করা হয় এবং প্রায়ই নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার করা হয়। জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিও আদার করা হয়।
ইরানে মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও সীমিত। সরকার কঠোরভাবে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং যে কন্টেন্ট সরকারের সমালোচনা বা ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে মনে হয় সেখানে সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। এর ফলে সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করা হয়েছে এবং সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে এমন মিডিয়া আউটলেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ইরানে নারী অধিকারও একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের বিষয়। দেশটিতে মহিলাদের কঠোর ড্রেস কোড মেনে চলতে হয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হয় এবং শিক্ষা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বাধার সম্মুখীন হয়।
সংখ্যালঘু অধিকার, বিশেষ করে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারও ইরানে উদ্বেগের বিষয়। এই সংখ্যালঘুরা বৈষম্য ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়, তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি প্রায়ই সরকার দ্বারা দমন করা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। সরকার নারীদের অধিকারের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন খেলাধুলা এবং রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের উপর কিছু বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া। তবে অনেক মানবাধিকার সংস্থা যুক্তি দেয় যে, ইরানে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবেলায় আরও অনেক কিছু করা দরকার।
ইরানের পরিবেশগত ইস্যু
ইরান বেশ কিছু পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন যা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং তার নাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে বায়ু দূষণ, জলের অভাব, বন উজাড় এবং মরুকরণ।
বায়ু দূষণ ইরানের বড় পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে একটি। তেহরান এবং ইসফাহান দূষিত শহর হিসেবে পরিচিত যেখানে উচ্চ মাত্রার কণা ও অন্যান্য দূষক পদার্থ রয়েছে। ট্রাফিক বৃদ্ধি, শিল্প কার্যকলাপ এবং বায়ু নির্গমন নিয়ন্ত্রণের কার্যকর অভাবের কারণে এমনটি ঘটেছে।
ইরানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত সমস্যা হলো পানির অভাব। দেশটি একটি শুষ্ক এবং আধা-শুষ্ক অঞ্চলে অবস্থিত এবং সীমিত মিঠা পানির সম্পদ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা আরও বেড়েছে, যার ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। ইরানের অনেক শহর পানির সংকটের সম্মুখীন এবং কৃষকরা প্রায়ই তাদের ফসল সেচের জন্য লড়াই করে।
ইরানে বন উজাড় করাও একটি সমস্যা, দেশটির বেশিরভাগ বন গাছ কাটা, কৃষি এবং নগরায়নের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। এটি মাটির ক্ষয় এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পাশাপাশি দেশের বায়ু দূষণ সমস্যায় অবদান রাখে।
ইরানে মরুকরণ আরও একটি বিরাট সমস্যা। দেশের ভূমির বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। মরুকরণ অত্যধিক চারণ, বন উজাড় এবং টেকসই কৃষি অনুশীলন সহ নানা কারণে ঘটে। মরুকরণ অনেক গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জীবিকার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং এতে করে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
ইরান সরকার এই পরিবেশগত সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রবিধান বাস্তবায়ন এবং জল ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা। যাইহোক, এই সমস্যাগুলি কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য আরও পদক্ষেপ হাতে নেওয়া দরকার।
ইরানের মিডিয়া
ইরানের মিডিয়াও সরকার দ্বারা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত। এতো কঠোর নিয়মাবলী দেশটির বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করছে। সরকার টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং রেডিও স্টেশন সহ বেশিরভাগ মিডিয়া আউটলেট নিয়ন্ত্রণ করে। ইরানের বিভিন্ন জনপ্রিয় সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে যেগুলি তার নাগরিকরা ব্যাপকভাবে দেখে এবং পড়ে। এই মিডিয়া আউটলেটগুলি জনমত গঠনে এবং ইরানের জনগণকে সংবাদ ও তথ্য প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদপত্রের নাম ইতেমাদ, ইংরেজিতে যার অর্থ “আস্থা”। এই সংবাদপত্রটি ইরানের রাজনীতি এবং সামাজিক সমস্যাগুলির স্বাধীন এবং সমালোচনামূলক কভারেজের জন্য পরিচিত। এটি 2002 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তারপর থেকে এটি ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্রের একটি হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের আরেকটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রের নাম Shargh, যার ইংরেজি অর্থ “East”। এই সংবাদপত্রটি 2003 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি ইরানের রাজনীতি এবং সামাজিক সমস্যাগুলির উদার ও প্রগতিশীল কভারেজের জন্য পরিচিত। Shargh ব্যাপকভাবে তরুণ ইরানিদের দ্বারা পঠিত হয় এবং দেশের পরিবর্তন ও সংস্কারের কণ্ঠস্বর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান ব্রডকাস্টিং (আইআরআইবি) হল দেশটির রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান এবং তারা বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল পরিচালনা করে। এই চ্যানেলগুলির মধ্যে রয়েছে IRIB 1, IRIB 2, IRIB 3, এবং IRIB 4, যার প্রত্যেকটির নিজস্ব প্রোগ্রামিং ব্যবস্থা এবং টার্গেট অডিয়েন্স রয়েছে। IRIB 1 চ্যানেল সংবাদ, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এবং বিনোদন সর্ম্পকিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে।
IRIB 2 যুব-ভিত্তিক প্রোগ্রামিং এর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং সঙ্গীত, খেলাধুলা এবং নাটক সিরিজ সম্প্রচার করে। IRIB 3 হল একটি স্পোর্টস চ্যানেল এবং লাইভ স্পোর্টিং ইভেন্টগুলি সম্প্রচার করে। অন্যদিকে IRIB 4 হল একটি আন্তর্জাতিক চ্যানেল যেটি একাধিক ভাষায় সংবাদ এবং কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ইনস্টাগ্রাম এবং টেলিগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিও খবর এবং তথ্যের বিকল্প উৎস হিসাবে ইরানীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলি ইরানীদের গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং তথ্য সংগ্রহের সুগোগ করে দেয় যা রাষ্ট্র-চালিত মিডিয়ার মতামতের বিরুদ্ধেও যেতে পারে।