আফগানিস্তান। বিশাল পাহাড়ে ঘেরা এশিয়ার অস্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত একটি রাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। পাকিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং চীনের সাথে সীমান্ত রয়েছে দেশটির। হাজার হাজার বছরের পুরোনো সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে দেশটির। আফগানিস্তান প্রাচীন বাণিজ্য রুট, এবং সাম্রাজ্রের কেন্দ্রস্থল। আজ আফগানরা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, চলমান সংঘাত, দারিদ্র্যসহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, আফগানিস্তান একটি বৈচিত্রময় সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ, যেখানে শিল্প, সঙ্গীত এবং সাহিত্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। আফগান জনগণ তাদের স্থিতিস্থাপকতা এবং আতিথেয়তার জন্য পরিচিত, এবং পর্যকটরা প্রায়শই দেশটির জনগণের উষ্ণতা এবং উদারতা দেখে অভিভূত হয়।
আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
রাষ্ট্রীয় নাম: ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান
রাজধানী: কাবুল
আয়তন: ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৬৪ বর্গ কিলোমিটার
জনসংখ্যা: প্রায় ৩ কোটি ৮৩ লাখ
ভাষা: পশতু, দারি
গড় আয়ু: পুরুষদের ৬৩ বছর, নারীদের ৬৬ বছর
ইতিহাস
যে অঞ্চলটি এখন আফগানিস্তান, তার একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহাসিক সিল্ক রোড বরাবর দেশের কৌশলগত অবস্থান এটিকে ইতিহাস জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। আফগানিস্তানও নানা বৈচিত্রের মানুষের আবাসস্থল ছিল এবং বহু সামরিক অভিযান প্রত্যক্ষ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পারস্য, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, মৌর্য সাম্রাজ্য, আরব মুসলিম, মঙ্গোল, ব্রিটিশ, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের আক্রমণ।
7ম শতাব্দীতে, ইসলাম এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি ইসলামী খেলাফতের অংশ হয়ে ওঠে। 10 শতকে, অঞ্চলটি সামানিদ সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়েছিল। 13শ শতাব্দীতে, আফগানিস্তান চেঙ্গিস খান এবং মঙ্গোলরা আক্রমণ করেছিল। যা 14 শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে মঙ্গোলরা শাসন অব্যাহত থাকে। 16 শতকে মুঘল সাম্রাজ্য এ ভূখন্ডে আধিপত্য বিস্তার করে।
আফগানিস্তানের আধুনিক রাষ্ট্রটি 18 শতকে দুররানি রাজবংশের শাসন দ্বারা শুরু হয়েছিল এবং দেশটি পতনের পরে একাধিক ছোট স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে গ্রেট গেমে আফগানিস্তান একটি বাফার রাষ্ট্রে পরিণত হয়। 20 শতকে, আফগানিস্তান 1919 সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাত অব্যাহত ছিল। আফগানিস্তান ১৯২৬ সালের জুন মাসে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে আবির্ভূত হয়, যা আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দী স্থায়ী হয়েছিল। 1979 সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে, যা সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ নামে পরিচিত একটি দশক-ব্যাপী সংঘাতের সূত্রপাত করে। এই সংঘাতের ফলে তালেবান সহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে, যারা 1996 সালে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
1970-এর দশকের শেষের দিক থেকে, আফগানিস্তানের ইতিহাস অভ্যুত্থান, আক্রমণ, বিদ্রোহ এবং গৃহযুদ্ধ সহ ব্যাপক যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। 1978 সালের সংঘাত থেকে কমিউনিস্ট বিপ্লবরক কেন্দ্র করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলে। 1979 সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বশক্তি নিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ করে। মুজাহিদিনরা সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং 1989 সালে সোভিয়েত সেনাদের প্রত্যাহারের পর নিজেদের মধ্যে লড়াই চলছিলো। ইসলামী মৌলবাদী তালেবান 1996 সালের মধ্যে দেশের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তালেবান সরকার 2001 সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের সময় পতনের আগে খুব কম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। আফগানিস্তানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সরকারকে উৎখাত করার পর 2021 সালে তালেবান কাবুল দখল করে ও পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। এইভাবে এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
ভূগোল
৬,৫২,২৩০ কিমি আয়তন-বিশিষ্ট দেশটি পৃথিবীর ৪১তম বৃহত্তম দেশ। উত্তর-পশ্চিম, পশ্চিম ও দক্ষিণের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি মূলত মরুভূমি ও পর্বতশ্রেণী। উত্তর-পূর্বে দেশটি ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে হিমবাহ-আবৃত পশ্চিম হিমালয়ের হিন্দুকুশ পর্বতের সাথে মিশে গেছে। আমু দরিয়া নদী ও এর উপনদী পাঞ্জ দেশটির উত্তর সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। ৭,৪৯২ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট নওশাক আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ও সর্বোচ্চ বিন্দু। এটি পাকিস্তানের তিরিচ মির পর্বতশৃঙ্গের একটি নিচু পার্শ্বশাখা। পর্বতটি আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বে হিন্দুকুশ পর্বতমালার অংশ, যেটি আবার পামির মালভূমির দক্ষিণে অবস্থিত। হিন্দুকুশ থেকে অন্যান্য নিচু পর্বতসারি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে প্রধান শাখাটি দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রসারিত হয়ে পশ্চিমের ইরান সীমান্ত অবধি চলে গেছে। এই নিচু পর্বতমালাগুলির মধ্যে রয়েছে পারোপামিসুস পর্বতমালা, যা উত্তর আফগানিস্তান অতিক্রম করেছে, এবং সফেদ কোহ পর্বতমালা, যা পাকিস্তানের সাথে পূর্ব সীমান্ত তৈরি করেছে। এখানে অবস্থিত বিখ্যাত খাইবার গিরিপথ, যা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে সংযুক্তকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ। নদী উপত্যকা ও কিছু ভূগর্ভস্থ পানিবিশিষ্ট নিম্নভূমি ছাড়া অন্য কোথাও কৃষিকাজ হয় না বললেই চলে। মাত্র ১২ শতাংশ এলাকা পশু চারণযোগ্য। দেশটির মাত্র ১ শতাংশ এলাকা বনাঞ্চল, এবং এগুলি মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানে অবস্থিত। যুদ্ধ ও জ্বালানি সংকটের কারণে বনভূমি দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তান এত পর্বতময় যে এগুলির মধ্যকার রাস্তাগুলি দেশটির বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার কুশান পাসের ভেতর দিয়ে এসে দেশটি আক্রমণ করেন এবং খাইবার পাস দিয়ে বের হয়ে গিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। অন্যদিকে সোভিয়েতরা সালাং পাস ও কেন্দ্রীয় হিন্দুকুশে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখল করে। আফগানিস্তানের বেশির ভাগ প্রধান নদীর উৎপত্তি পার্বত্য জলধারা থেকে। দীর্ঘস্থায়ী শুষ্ক মৌসুমে বেশির ভাগ নদী শীর্ণ ধারায় প্রবাহিত হয়। বসন্তে পর্বতের বরফ গলা শুরু হলে এগুলিতে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। বেশির ভাগ নদীই হ্রদ, জলাভূমি কিংবা নোনাভূমিতে পতিত হয়। এদের মধ্যে কাবুল নদী ব্যতিক্রম; এটি পূর্বে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানের সিন্ধু নদের সাথে মেশে, যা পরে ভারত মহাসাগরে গিয়ে পতিত হয়। দেশটির একমাত্র নৌ-পরিবহনযোগ্য নদীটি হল উত্তর সীমান্তের আমু দরিয়া।
জলবায়ু
আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকাতেই সুমেরুদেশীয় পার্বত্য জলবায়ু বিদ্যমান। এখানে শীতকাল শুষ্ক। আফগানিস্তানে মূলত দুইটি ঋতু। গরম গ্রীষ্মকাল এবং অত্যন্ত শীতল শীতকাল। উত্তরের উপত্যকায় গ্রীষ্মে ৪৯° সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে হিন্দুকুশ ও আশেপাশের ২০০০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট অঞ্চলে তাপমাত্রা -৯° সেলসিয়াসে নেমে পড়ে। অন্যান্য উঁচু এলাকায় উচ্চতাভেদে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে। এমনকি একই দিনে তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য ঘটতে পারে। বরফজমা ভোর থেকে দুপুরে ৩৫° তাপমাত্রা ওঠা বিচিত্র নয়। অক্টোবর ও এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টিপাত হয়। মরুভূমি এলাকায় বছরে ৪ ইঞ্চিরও কম বৃষ্টি পড়ে। অন্যদিকে পর্বত এলাকায় বছরে জলপাতের পরিমাণ ৪০ ইঞ্চিরও বেশি, তবে এর বেশির ভাগই তুষারপাত।
প্রাকৃতিক সম্পদ
আফগানিস্তানে ছোট আকারে মণি, সোনা, তামা ও কয়লা উত্তোলনের ইতিহাস থাকলেও খনিজ আহরণ ১৯৬০-এর দশকের আগে শুরু হয়নি। ১৯৭০-এর দশকে দেশটির উত্তরাঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাসের উল্লেখযোগ্য মজুদ আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া পেট্রোলিয়াম ও কয়লাও এখানে পাওয়া যায়। দেশটিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তামা, লোহা, বেরাইট, ক্রোমাইট, সীসা, দস্তা, গণ্ধক, লবণ, ইউরেনিয়াম ও অভ্রের মজুদ আছে। তবে সোভিয়েত আক্রমণ এবং তৎপরবর্তী গৃহযুদ্ধের কারণে আফগানিস্তান এই খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। অদূর ভবিষ্যতে এগুলি নিষ্কাশনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বহু শতাব্দী ধরে আফগানিস্তান দুষ্প্রাপ্য ও অর্ধ-দুষ্প্রাপ্য পাথরেরও একটি উৎসস্থল, যাদের মধ্যে আছে নীলকান্তমণি, চুনি, নীলা ও পান্না।
শাসনব্যবস্থা এবং রাজনীতি
আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। আফগানিস্তানের সরকার তিনটি শাখায় বিভক্ত: নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগীয় শাখা। নির্বাহী শাখা রাষ্ট্রপতি, ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভা নিয়ে গঠিত। আইনসভা শাখা জাতীয় পরিষদের সমন্বয়ে গঠিত। বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট এবং আপিল আদালত অন্তর্ভুক্ত।
তালেবান, একটি ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী যারা 1996 থেকে 2001 পর্যন্ত আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে। দেশ থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের পর তালেবান 2021 সালের আগস্টে দেশটির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে। তালেবানের রাজনৈতিক মতাদর্শ ইসলামী আইন বা শরিয়ার কঠোর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে। তারা আফগানিস্তানের একটি ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেছে। ইতিমধ্যেই তাদের শাসনের রূপকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে কঠোর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়মাবলী আরোপ করা ও নারীর অধিকার সীমিত করা। তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগের মুখোমুখি হয়েছে।
আফগানিস্তান প্রশাসনিকভাবে ৩৪টি প্রদেশ বা ওয়েলায়েত-এ বিভক্ত। প্রতি প্রদেশের নিজস্ব রাজধানী আছে। প্রদেশগুলি আবার জেলায় বিভক্ত। একেকটি জেলা সাধারণত একটি করে শহর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী প্রতিটি প্রদেশে একজন করে গভর্নর নিয়োগ করেন। গভর্নর কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রদেশের পুলিশ প্রধানকেও অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী নিয়োগ দেন।
শুধুমাত্র কাবুল শহরে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। সেখানে শহরের মেয়রকে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন এবং শহরটির প্রশাসন কাবুল প্রদেশ থেকে স্বাধীন। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দেশটির পূর্ব-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত। অন্যান্য প্রধান শহরের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণের কান্দাহার, পশ্চিমের হেরত এবং উত্তরের মাজরে শরীফ। ছোট শহরগুলির মধ্যে আছে পূর্বের জালালাবাদ, কাবুলের উত্তরে অবস্থিত চারিকার, এবং উত্তরের কন্দোজ ও ফয়েজাবাদ।
সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময়ে ও ১৯৮৯ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পরে গ্রামাঞ্চল থেকে বহু মানুষ জনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে এসে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নেয়। ১৯৮০-এর শেষের দিকে কাবুলের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ২০ লক্ষ হয়ে যায়। তবে ১৯৯০-এর শুরুর দিকের গৃহযুদ্ধের সময় অনেক লোক বিধ্বস্ত কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যায়; ফলে ১৯৯৩ সালে এর জনসংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৭ লক্ষ। তবে ২০০১ সালের পর এর জনসংখ্যা আবার বেড়ে ২০ লক্ষে গিয়ে পৌঁছেছে। বেশির ভাগ শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানি শোধন ব্যবস্থা ও জনপরিবহন ব্যবস্থা নেই।
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, আফগানিস্তান দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাহীনতার চলমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দেশটি ব্যাপক দারিদ্র্য এবং বিপর্যস্ত অর্থনীতির সাথেও লড়াই করেছে, যার ফলে সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতি
লিথিয়াম, লোহা, দস্তা এবং তামা সহ সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, আফগানিস্তান সাম্প্রতিক দশকগুলিতে দারিদ্র্য এবং সন্ত্রাসবাদের সাথে লড়াই করেছে। আফিম ও গাঁজা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। আফগানিস্তান বিশ্বের 96তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে আফগানিস্তানকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানব উন্নয়ন সূচকে দেশটির অবস্থান 180 তম। মাথাপিছু জিডিপি হিসাব করলে 186টি দেশের মধ্যে দেশটির অবস্থান 169তম।
সোভিয়েত অধিকৃতির আগেই আফগানিস্তানে জীবনযাত্রার মান ছিল বিশ্বের সর্বনিম্ন। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ ও তার পরে গৃহযুদ্ধ দেশটির অর্থনীতির চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটায়। সোভিয়েত আমলে শহরকেন্দ্রিক বাণিজ্য ও শিল্প সুযোগ সুবিধা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শুরু থেকে আলাদা করে ফেলে।
আফগানরা মূলত কৃষক ও পশুপালক। ২০শ শতকে খনি ও ভারী শিল্পের উন্নতি ঘটে, তবে স্থানীয় হস্তশিল্প গুরুত্ব হারায়নি। ১৯৫৬ সালে সরকার অনেকগুলি পাঁচসালা পরিকল্পনার প্রথমটি শুরু করে। ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগে নেয়া প্রকল্পগুলি সাফল্যের মুখ দেখে। অন্যান্য বড় দেশের সহায়তায় আফগানিস্তান রাস্তা, বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বিমানবন্দর, কারখানা ও সেচ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েতরা আসার পর পশ্চিমা সাহায্য বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত শাসনের মুক্তির পর আবার সাহায্য আসা শুরু হয়।
আফগানদের প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষিকাজ বা পশুপালনের সাথে জড়িত। গম আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শস্য। এরপর রয়েছে যব, ভুট্টা, ও ধান। তুলাও ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। আফগানিস্তান থেকে রপ্তানিকৃত দ্রব্যের মধ্যে ফল ও বাদাম গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানের আঙুর ও তরমুজ খুব মিষ্টি হয়; এগুলি দক্ষিণ-পশ্চিমে, হিন্দুকুশের উত্তরে ও হেরাতের আশেপাশের অঞ্চলে জন্মে। আফগানিস্তান কিশমিশও রপ্তানি করে। অন্যান্য ফলের মধ্যে রয়েছে এপ্রিকট, চেরি, ডুমুর, তুঁত, ও ডালিম।
আফগানিস্তানের রপ্তানিকৃত দ্রব্যের মধ্যে শুকনা ফল ও বাদাম, হস্তনির্মিত কার্পেট, পশম, তুলা, চামড়া, ও নানা ধরনের মণিপাথর প্রধান। আফগানিস্তান বিদেশ থেকে খাদ্য, মোটর যান, পেট্রোলিয়াম, ও কাপড় আমদানি করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলি, পাকিস্তান, ভারত, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি আফগান পণ্যের প্রধান ক্রেতায় পরিণত হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
আফগানিস্তানের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশ অনুন্নত। বেশিরভাগ রাস্তাই কাঁচা এবং খারাপভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। দেশের রুক্ষ ভূখণ্ড এবং অবকাঠামোর অভাবও দক্ষ পরিবহন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা কঠিন করে তুলেছে। যাইহোক, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কিছু প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
আফগানিস্তানের প্রধান মহাসড়কগুলির মধ্যে রয়েছে কাবুল-কান্দাহার হাইওয়ে, যা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, যা রাজধানী কাবুলকে দক্ষিণের শহর কান্দাহারের সাথে সংযুক্ত করে। অন্যান্য প্রধান মহাসড়কের মধ্যে রয়েছে কাবুল-জালালাবাদ হাইওয়ে, যা কাবুলকে পূর্বাঞ্চলীয় শহর জালালাবাদের সাথে সংযুক্ত করে এবং হেরাত-কান্দাহার হাইওয়ে, যা পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হেরাতকে কান্দাহারের সাথে সংযুক্ত করে।
দেশটির একটি সীমিত রেলওয়ে নেটওয়ার্কও রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাইন হল হাইরাতান থেকে মাজার-ই-শরীফ রেলপথ, যা আফগানিস্তানকে উজবেকিস্তানের সাথে সংযুক্ত করে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
আফগানিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ দূরত্ব ভ্রমণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল বিমান পরিবহন, কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর। বিমানবন্দরটি বিভিন্ন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইটের ব্যবস্থা রয়েছে।
এছাড়াও, কান্দাহার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মাজার-ই-শরীফ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং হেরাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সহ দেশের অন্যান্য অংশে কয়েকটি ছোট বিমানবন্দর রয়েছে। যাইহোক, এই বিমানবন্দরগুলির অনেকেরই সীমিত সুবিধা রয়েছে এবং সবসময় নির্ভরযোগ্য নয়।
শিল্প খাত
আফগানিস্তানের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে। খনির খাত দেশের জিডিপিতে অবদান রাখে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিল্পের মধ্যে রয়েছে উত্পাদন, নির্মাণ এবং পরিষেবা।
কৃষি আফগানিস্তানের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসাবে রয়ে গেছে। দেশটি উচ্চ মানের ফল যেমন ডালিম, আঙ্গুর এবং তরমুজের পাশাপাশি পেস্তা এবং বাদাম উৎপাদনের জন্য পরিচিত। আফগানিস্তানও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাফরান উৎপাদনকারী দেশ।
আফগানিস্তান তামা, লোহা আকরিক, সোনা, লিথিয়াম এবং বিরল আর্থ ধাতুর মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় খনির খাতকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি সম্ভাব্য মূল চালক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে, নিরাপত্তাহীনতা, অবকাঠামোর অভাব এবং দুর্নীতির মতো চ্যালেঞ্জে জর্জরিত এই খাত।
আফগানিস্তানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হল ম্যানুফ্যাকচারিং, যেখানে টেক্সটাইল, কার্পেট এবং আসবাবপত্র উৎপাদন ইত্যাদি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পুনর্গঠন প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশের নির্মাণ শিল্পও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিষেবা খাত, বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ এবং আর্থিক পরিষেবা খাতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে। তবে এই খাতটি অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনুন্নত রয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
আফগানিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা কয়েক দশকের সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার কারণে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তালেবান শাসনামলে মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয় এবং অনেক স্কুল ধ্বংস করা হয়। 2001 সালে তালেবানদের উৎখাতের পর থেকে, শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা আফগানিস্তানের সকল শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক। যদিও দারিদ্র্য, অবকাঠামোর অভাব এবং সাংস্কৃতিক নিয়মের মতো কারণগুলির কারণে কিছু এলাকায় উপস্থিতির হার কম। মাধ্যমিক শিক্ষা এ দেশে বাধ্যতামূলক নয়, এবং অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে তাদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে সক্ষম নয়।
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় সহ আফগানিস্তানে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে রয়েছে হেরাত বিশ্ববিদ্যালয়, বলখ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কান্দাহার বিশ্ববিদ্যালয়। যাইহোক, আফগানিস্তানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, শিক্ষাকে আফগানিস্তানের উন্নয়নে একটি মূল কারণ হিসেবে দেখা হয় এবং এটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু।
স্বাস্থ্যসেবা
চলমান সংঘাত এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সহ আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বছরের পর বছর ধরে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। ফলস্বরূপ, দেশটিতে বিশ্বের সর্বনিম্ন আয়ু এবং সর্বোচ্চ শিশুমৃত্যু হারের ঘটনা ঘটেছে।
জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানের জন্য দায়ী। যাইহোক, দেশের সীমিত সম্পদের কারণে, অনেক এলাকায় মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো এবং চিকিৎসা পরিষেবার অ্যাক্সেসের অভাব রয়েছে। এছাড়াও, নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পর্কিত পেশাজীবীরাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি আফগানিস্তানে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক প্যাকেজ (BPHS) 2003 সালে চালু করা হয়েছিল, যা দেশুটির জনগণকে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। এখন টিকাদান, প্রসবপূর্ব যত্ন এবং সাধারণ রোগের চিকিৎসার মতো পরিষেবাগুলি এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এছাড়াও, আফগানিস্তানে স্বাস্থ্যসেবা সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য সংস্থাগুলি যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া এবং এইচআইভি/এইডসের মতো সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর উচ্চহার কমাতে মা ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সংস্কৃতি
আফগানিস্তান তার সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম হওয়ায় ইসলামিক ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি দৈনন্দিন জীবনের সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলে।
দেশটিতে মৌখিক গল্প, কবিতা এবং সঙ্গীতের একটি শক্তিশালী ঐতিহ্য রয়েছে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গল্প এবং ইতিহাস ছড়িয়ে পড়ে। রুবাব, সরোদ এবং ঢোলের মতো ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রগুলি সাধারণত আফগান সঙ্গীতে ব্যবহৃত হয়।
আফগানিস্তানের কার্পেট, সূচিকর্ম এবং মৃৎশিল্পে সৃজনশীলতার উপস্থিতি রয়েছে। এই কারুশিল্পগুলির মধ্যে অনেকগুলি গ্রামীণ এলাকায় মহিলাদের দ্বারা উত্পাদিত হয় এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখনও চালু রয়েছে।
দেশের রন্ধনপ্রণালী তার ভূগোল এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। আফগান রন্ধনপ্রণালী হল মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্বাদ এবং মশলার মিশ্রণ। জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে কাবাব, ভাতের খাবার, স্যুপ এবং স্টু। চা হল সবচেয়ে সাধারণ পানীয়, এবং এটি প্রায়শই মিষ্টি এবং পেস্ট্রির সাথে পরিবেশন করা হয়।
আফগানিস্তানে ক্রিকেট, ফুটবল এবং বুজকাশি (একটি ঐতিহ্যবাহী আফগান খেলা) খেলাধুলা বেশ জনপ্রিয়। দেশটি বেশ কয়েকজন অলিম্পিক পদকপ্রাপ্ত সহ বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াবিদ তৈরি করেছে।
পরিবেশগত বিষয়
আফগানিস্তান বন উজাড়, মাটির ক্ষয়, পানির অভাব এবং বায়ু দূষণ সহ বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন। আফগানিস্তানে প্রতিনিয়ত বন উজাড় হচ্ছে যা একটি বড় সমস্যা। দেশটি গত কয়েক দশকে গাছ কাটা, চারণ এবং কৃষির কারণে অর্ধেকেরও বেশি বনভূমি হারিয়েছে।
মাটির ক্ষয়ও আফগানিস্তানে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। অতিরিক্ত চরানো, টেকসই কৃষি অনুশীলন এবং অন্যান্য কারণের ফলে উপরের মাটির ক্ষতি হয় এবং উর্বরতা হ্রাস পায়। এটি খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি উৎপাদনশীলতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
পানির অভাব আফগানিস্তানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সমস্যা। দেশের অনেক অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতি রয়েছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি জল সম্পদের অত্যধিক ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার কারণে হয়েছে।
শহরাঞ্চলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ যেখানে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পানি সরবরাহে উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেছে। বায়ু দূষণ আফগানিস্তানের অনেক অংশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে বিবেচিত।
মানবাধিকার
আফগানিস্তান বহু বছর ধরে অসংখ্য মানবাধিকার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। দেশটি কয়েক দশক ধরে সংঘাত ও অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে, যার ফলে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন হয়েছে।
নারীর অধিকার: আফগানিস্তানের নারীরা তাদের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তালেবান শাসন নারীদের শিক্ষা গ্রহণ, তাদের বাড়ির বাইরে কাজ করা এবং স্বাস্থ্যসেবা অ্যাক্সেস নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও তালেবান ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর থেকে নারীদের অধিকারে কিছু উন্নতি হয়েছে।
শিশুশ্রম: আফগানিস্তানে শিশুশ্রম একটি গুরুতর সমস্যা, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে দরিদ্রতা বেশি। শিশুরা প্রায়ই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য হয় এবং তারা তাদের শিক্ষা এবং শৈশব থেকে বঞ্চিত হয়।
বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: আফগানিস্তানে সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মীরা সরকার, সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং যুদ্ধবাজদের সহ বিভিন্ন অভিনেতাদের হুমকি, ভয়ভীতি এবং সহিংসতার সম্মুখীন হন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিকদের হত্যা বা হামলার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।
নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার: আফগানিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা বন্দীদের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। আটক ব্যক্তিদের মারধর, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট এবং অন্যান্য ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
খাবার
আফগান রন্ধনপ্রণালী তার সমৃদ্ধ স্বাদ এবং বিভিন্ন ধরনের মশলার জন্য পরিচিত। সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু খাবারের মধ্যে রয়েছে:
কাবুলি পোলাও: ভাত, ভেড়ার মাংস, গাজর, কিশমিশ এবং বাদাম দিয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার।
মান্টু: মশলাযুক্ত গরুর মাংস বা ভেড়ার মাংস দিয়ে এ খাবার প্রস্তুত করা হয়। টমেটো-ভিত্তিক সস এবং দই দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
আশক: একটি মাংস বা উদ্ভিজ্জ সসের সাথে এটি পরিবেশন করা হয় এবং পাশাপাশি দই ও শুকনো পুদিনা ব্যবহার করা হয়।
বোলানি: আলু, পালং শাক বা কুমড়ার দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা তৈরি করা হয়।
কোরমা: মাংস, শাকসবজি এবং মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রায়শই ভাতের সাথে কোরমা পরিবেশন করা হয়।
চা: আফগান সংস্কৃতির একটি প্রধান পানীয়, প্রায়শই চিনি এবং এলাচ দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
শরবত: একটি মিষ্টি, ফলের পানীয় যা প্রায়শই বিবাহ এবং উদযাপনের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।
দেশটির রন্ধনপ্রণালী তার সমৃদ্ধ এবং সুস্বাদু খাবারের জন্য পরিচিত। রান্নার সময় প্রায়শই বিভিন্ন ভেষজ এবং মশলা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আফগানিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হল কাবুলি পোলাও যা বাসমতি চাল, ভেড়ার মাংস, গাজর, কিশমিশ এবং এলাচ এবং জিরা সহ বিভিন্ন ধরনের মশলা দিয়ে তৈরি একটি চালের খাবার। তবে আফগান রন্ধনপ্রণালী ভারত, ইরান এবং পাকিস্তানের সংস্কৃতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।
ভ্রমণের স্থান
আফগানিস্তানে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।
কাবুল: আফগানিস্তানের রাজধানী শহরটি আধুনিক ভবন এবং কাবুল জাদুঘর, বাবরের উদ্যান এবং শাহ-দো শামশিরা মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থানের জন্য সুপরিচিত।
বামিয়ান: মধ্য আফগানিস্তানে অবস্থিত বামিয়ান উপত্যকা বামিয়ানের বিখ্যাত বুদ্ধদের আবাসস্থল, যেগুলি ২০০১ সালে তালেবানদের দ্বারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এই উপত্যকায় বরফে ঢাকা পাহাড় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
হেরাত: ‘খোরাসানের মুক্তা’ নামে পরিচিত, হেরাত পশ্চিম আফগানিস্তানে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর। এখানে হেরাত দুর্গ, হেরাতের গ্রেট মসজিদ এবং শুক্রবারের মসজিদের মতো অনেক আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে।
মাজার-ই-শরীফ: আফগানিস্তানের চতুর্থ বৃহত্তম শহর, মাজার-ই-শরীফ ব্লু মসজিদের আবাসস্থল, যা বিশ্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ইসলামিক মাজার। এটি তার প্রাণবন্ত বাজার এবং বলখ হেরিটেজ পার্কের জন্যও পরিচিত।
সেলিব্রেটি
আফগানিস্তানে সাহিত্য, রাজনীতি, খেলাধুলা, সঙ্গীত এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ রয়েছে। কিছু বিখ্যাত আফগান সেলিব্রিটিদের মধ্যে রয়েছে:
খালেদ হোসেইনি – একজন আফগান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক, চিকিত্সক এবং কর্মী, যিনি তার সর্বাধিক বিক্রিত উপন্যাস “দ্য কাইট রানার” এর জন্য সর্বাধিক পরিচিত।
আহমদ জহির – একজন প্রখ্যাত আফগান গায়ক যাকে প্রায়ই “আফগানিস্তানের এলভিস” বলা হয়। তিনি তার অনন্য কণ্ঠস্বরের জন্য সুপরিচিত।
হামিদ কারজাই – আফগানিস্তানের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি যিনি 2001 থেকে 2014 সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তালেবান শাসনের পতনের পর তিনি দেশকে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টার জন্য পরিচিত।
আশরাফ ঘানি – আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি যিনি 2014 সালে কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দেশের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার উন্নতির লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার ও উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য কৃতিত্ব পেয়েছেন।
রবিনা মুকিমিয়ার – একজন তরুণ আফগান সাংবাদিক যিনি 2018 সালে দেশের প্রথম মহিলা সংবাদ উপস্থাপক হয়েছিলেন। তিনি আফগানিস্তানে বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের প্রচারে তার সাহস এবং উত্সর্গের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
সংবাদপত্র
আফগানিস্তানের বিভিন্ন ধরনের সংবাদপত্র রয়েছে যেগুলি দারি, পশতু এবং ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়। আফগানিস্তানের কিছু জনপ্রিয় সংবাদপত্রের মধ্যে রয়েছে:
দৈনিক আফগানিস্তান: কাবুল থেকে দারি এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশিত একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা।
Hasht-e Sobh Daily: রাজনীতি এবং সামাজিক সমস্যাগুলির উপর ফোকাস সহ দারি ভাষার একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা।
8 সোব দৈনিক: খবর, রাজনীতি এবং সামাজিক সমস্যাগুলির উপর ফোকাস সহ দারি ভাষার একটি দৈনিক সংবাদপত্র।
ডেইলি আউটলুক আফগানিস্তান: একটি দৈনিক ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ কভার করে।
মান্দেগার দৈনিক: দারি ভাষার একটি দৈনিক সংবাদপত্র যা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংবাদ কভার করে।
আফগানিস্তান টাইমস: একটি সাপ্তাহিক ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র যা শনিবারে প্রকাশিত হয়। রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং খেলাধুলার নিউজ বেশি কভার করা হয়।
রেডিও
আফগানিস্তানের রেডিও চ্যানেলের ধরণ বেশ বৈচিত্র্যময় যেখানে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল এবং সম্প্রদায়কে উপস্থাপনা করা হয়। আফগানিস্তানের রেডিও স্টেশনগুলি পশতু, দারি, উজবেক, তুর্কমেন, বেলুচি সহ বিভিন্ন ভাষায় সম্প্রচার করে।
আফগানিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রেডিও স্টেশনগুলির মধ্যে রয়েছে রেডিও আফগানিস্তান, আরিয়ানা এফএম, আরমান এফএম এবং টোলো এফএম। রেডিও আফগানিস্তান একটি রাষ্ট্র-চালিত মিডিয়া যা 90 বছরেরও বেশি সময় ধরে service দিয়ে আসছে। এসব রেডিও চ্যানেল বিভিন্ন ভাষায় সংবাদ, সঙ্গীত এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচার করে। আরিয়ানা এফএম এবং আরমান এফএম হল প্রাইভেট ব্রডকাস্টার যারা খবর, মিউজিক এবং বিনোদন প্রোগ্রামিং অফার করে, যেখানে টোলো এফএম তার খবর এবং কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্রোগ্রামিংয়ের জন্য পরিচিত।
এই প্রধান রেডিও স্টেশনগুলি ছাড়াও, অনেকগুলি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন রয়েছে যা নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং সম্প্রদায়কে রিপ্রেজেন্ট করে। এই স্টেশনগুলি প্রায়ই স্থানীয় এনজিও দ্বারা পরিচালিত হয় এবং স্থানীয় ভাষায় সংবাদ, তথ্য এবং বিনোদন প্রচার করে। আফগানিস্তানের কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের কিছু উদাহরণ হল রেডিও বামিয়ান, রেডিও সাহার এবং রেডিও কিলিড।
সামগ্রিকভাবে, রেডিও আফগানিস্তানে সংবাদ ও তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের অ্যাক্সেস সীমিত।